Wednesday, October 24, 2012

গরু কেনা, গরু আনা


ভুমিকা ছাড়াই সুচনা
বিশাল কাজ করে আসলাম। কোরবানির গরু কিনে আনলাম। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে একটা হাত তালি দেন, এরপর আমি বিস্তারিত শুরু করছি।
জানি, প্রথমেই জিজ্ঞেস করবেন, কি ভাই?? গরু কত নিল???
গাবতলী থেকে রূপনগর আসতে আসতে এই প্রশ্নের উত্তর ৫৪৪ জনকে দিলাম (আমি দেই নাই। গরু ধরে নিয়ে যে দু'জন আসছিলো, তারা জবাব দিচ্ছিল। আর আমি গুনছিলাম।) তো আপনাদের দিতে আর অসুবিধা কই? যাই হোক, গল্পটা তাহলে শুরু থেকেই বলি।

জীবনে এই প্রথম আমি গরুর হাঁটে গেলাম গরু কেনার উদ্দেশ্য নিয়ে। ২দিন ধরে ১০১-১০২ এর ভেতর জ্বর উঠা নামা করছিলো। এই অবস্থায় গরুর হাঁটে যাওয়ার কথা ভাবতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। তবে, এবার বাবা ব্যাংক থেকে ছুটি পান নাই বেশি। ঢাকা আসবেন সেই শুক্রবার, তাই আমারই যে এবার গরু নিয়ে ছুটতে হবে সেটা পুনঃনির্ধারিতই ছিল। প্রথমবারের মত যাব দেখে দো'তলার মামাকে বলে রেখেছিলাম, "হাঁটে যেদিন যাবেন, আমাকে নিয়ে যাইয়েন।" কাল রাতে (মতান্তরে আজ ভোরে) ৬টার দিকে ঘুমাই। হঠাত্ ৯টা বাজতেই আম্মুর ডাক। এত সকালে মা কখনো আমাকে ডাকেন না ছুটির দিনগুলোতে।
তাই, ধড়ফড় করে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হইছে?"
মা বললেন, "গরুর হাঁটে যাচ্ছে। তোকে ডাকছে।"
জাপানীদের মতো কুতকুতে চোখে মা'র আবছা অবতারকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, "কয়টা বাজে?"
মা বললেন, "সাড়ে নয়টা!" উনি জানেন যে আমি উঠতে আধা ঘন্টার কম নেই না। তাই সবসময় একটু বাড়িয়ে বলে রাখেন।
কিন্তু, আজ কি মনে হতেই তখনই উঠেই মুখ ধুয়ে নিচে নেমে গেলাম। দেখি, সবাই তৈরী। আমি আসতেই বললেন, "চলো বাবা! রওয়ানা দেই।"
মনটা তখন সকালের নাস্তার জন্য পোড়াচ্ছিলো, তবে কিছু করার নেই। তাই, পাংশু মুখে একটা হাসি টেনে বললাম, "চলেন মামা!"


গন্তব্য নিয়ে মন্তব্য
আমাদের বাড়ি রূপনগরে। রিক্সা যোগে আসলাম মিরপুর ১ এর মুক্তবাংলার সামনে। সেখান থেকে বাসে করে আসলাম গাবতলী গরুর হাঁটে। তবে, বিপত্তি বেঁধে ছিল মুক্তবাংলার সামনেই। তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে মুঠোফোন খানা বাসায়ই ফেলে গিয়েছিলাম। রিক্সা করে মিরপুর ১ এ আসার সময় মামাদের রিক্সা হারিয়ে ফেলে আমাদের রিক্সাওয়ালা। তাঁদের খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে, আমার সাথে ফাহিম (মামার ছেলে, মতান্তরে মামাতো ভাই) থাকায় রক্ষা। পাবলিক ফোন বুথ থেকে মামাকে ফোন করে আবার এক সাথে হলাম।
মামার পিয়নের মন্তব্য, "হাঁটে যাওনের আগেই হারাই গেলে, ঐখানে গিয়ে কি কইরবেন ভাইজান?"
মন্তব্যের জবাবে একটা কাষ্ঠল হাসি ছাড়া দেওয়ার মত কিছুই ছিল না আমার।


গো-অন্বেষা
গো-অন্বেষা বা, গবেষনা বা, গরু খোঁজার ব্যাপার আসছি। আমার কাছে গরু প্রধানত ২ প্রকার। পুরুষ গরু বা, বলদ এবং মাদী গরু বা, গাভী। কিন্তু, কোরবানির হাটে যেহেতু গাইয়ের কোন স্থান নাই... তাই বিভাজন এবার ৩ ভাগে। ছোট গরু, বড় গরু, বেশি বড় গরু।
আমার দৃষ্টি ছিল বড় গরুর দিকে। অনেক গরু দেখলাম। কয়েকটার দামও জিজ্ঞেস করলাম, কারন দাম জিজ্ঞেস করতে তো আর পয়সা লাগে না। বেশি দাম চাইতেও পয়সা লাগে না। তাই অনেকেই লাখ টাকা বা, এর কাছাকাছি দাম হাঁকাচ্ছিলেন। আমরা হাসলাম। মামা তো বলেই ফেললেন, "তোমাদের গরুর হাঁটে থাকতে আরাম লাগতাছে, বুঝতেছি। থাক, তোমরাই থাকো। আমরাই যাই।"
আজকের বাজার গত কয়েকদিনের তুলনায় খানিকটা বাড়তি ছিল। গরুর মূল বিক্রেতাদের চাইতে দালালদের বিচরনই ছিল বেশ দাপটের। তারা মানুষের জাত-বয়স বিবেচনা না করেই শ্লীল-অশ্লীল অনেক মন্তব্যই করছিল, যা ছিল মোটামোটি বিব্রতকর। আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় ছিল, "কালো বাচ্চাটা দেইখা যান!" "সাদা বাচ্চাটা লইয়া যান!" "লাল বাচ্চাটার দিক একটু তাকান!" স্বরূপ ভেসে আসা বিভিন্ন হাঁক-ডাক। মনে হবে, যেন কারও বাচ্চা গরু কিনতে আসার পর হারানো গিয়েছে। প্রতিবারই হাঁকের চোটে আমি ফিরে তাকালেও সেখানে দামড়া একটা বলদ ছাড়া কোন প্রকার বাচ্চার নাম নিশানা দেখলাম না। এভাবে মানুষকে ঠকানোর কোন মানে হয়? তাছাড়াও, অসুস্থ গরু, বিদেশি গরু, শংকর গরু, ইঞ্জেকশন দেওয়া গরু ইত্যাদি ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা উতড়ে একটা সাদা রং এর বলদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করলো তার ব্যাক্তিত্বপূর্ণ বলদামি দিয়ে। "মারে না-কো ঠুস ঠাস, করে না-কো ফোস ফাস।" এমন গরুই তো আমরা খুঁজছিলাম।
মামার পিয়ন, গরুটাকে দেখে বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করলেন, "গরুডা ভালা আছে। আগা-পাছা সমান। শান্ত থাকবো গরুডা।"
তারপর পাত্রী পছন্দ করার মত গরুটিকে হাটিয়ে দেখলেন মামারা। গরুটির সামনে পেছনে দেখা শেষ করে কাউ-ওয়াক করিয়ে মোটামোটি তাকে পাস মার্ক দিলেন। ভাগ্যিস গরুরা গান গাইতে পারে না। নইলে নিশ্চয়ই গান না শুনে পিয়নটা গরু পছন্দ করতে দিতই না।


কি পেলাম, কি দিলাম
সবাই নিশ্চয়ই ভাবছেন, পরীক্ষার নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য বাড়তি পয়েন্ট লিখতে লিখতে আমার অভ্যাশটা গেছে। তাই এই চরনটা যোগ করেছি। কারন, কোরবানির আগে মানুষ গরু পেতে টাকা দিতেই হাঁটে যায় - এই কথা চন্দ্র, সূর্য, তারকার মতই সবাই জানে। সে নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন কারন অনেকেই খুঁজে পাবেন না। তবে, আমি বলছি। শুধু, গরু পেয়েই আমাকে ক্ষান্ত হতে হয় নি। আরও অনেক কিছুই পেয়েছি। গরুর হাঁটে ঢোকার একটু পরই ফাহিমের কমলা রং এর ব্যাগ এক গরুর অনেক পছন্দ হয় যায়। সেটা একটু ভাল করে দেখার জন্য সে ছুটে আসে। তখন সেই গরুটাকে আটকানোর সময় একখান লাত্থি খাই পায়ে। তাছাড়া, গরুর হাটের 'গভীরে আরও গভীরে' ঢোকার সময় বিশিষ্ট গরু ব্যাক্তিত্বগন আমাকে লেজুরে সম্ভাষন (সোজা কথায়, লেজের বাড়ি) জানায়। এছাড়াও গোমূ্ত্র-গোবরসমূহের গন্ধ তো ছিল বোনাস।


গো-যাত্রা
গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য ২ জন লোক ঠিক করেছিলাম। সাথে আমিও থাকলাম দেখে রাখার জন্য। অনেকক্ষন বাঁধা অবস্থায় ছিল দেখে কি না জানি না, তবে রাস্তায় নামাতে শান্ত গরুটি হঠাত্ ঘোড়া হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির রাস্তা চিনে গরু নিজেই যেন আমাদের আগে ফিরে আসবে। যাই হোক, আমরা গরুর পেছনে দৌড়ে দৌড়ে গাবতলী চলে এলাম। তারপর আবার গরুর প্রতিভা প্রদর্শন শুরু করলো। জীবনে অনেক গরু দেখেছি, তবে বুদ্ধিমান গরু এই প্রথম দেখলাম। ভাবতে ভাল লাগছে, আমরা এখন এক বুদ্ধিমান গরুর মালিক। কেন বুদ্ধিমান বলছি, তা পরিষ্কার করছি। আমাদের গরুটি রাস্তা দিয়ে আসার সময় কোন ছোট গরু দেখলেই দৌড়ে যেত ঢুসা মারতে। আর বেশি বড় কোন গরু দেখলে, চুপচাপ দেনাদারের মত মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে আসে। আর প্রখর রোদে একটু ছায়া পেলেই তার চলন মহারানী নব্বই তম এ্যলিযাবেথ হয়ে যায়। আহা, গরমের আরাম গরুতেও বোঝে। যাত্রা পথে সচরাচর বাঙালী নিজের ধর্ম সুষ্ঠুরূপে পালন করে। অর্থাত্, বারং বার জিজ্ঞাসা করে, "গরু কত নিল?"
আরে ভাই, গরু নিব কেমনে? সব টাকা তো গরুর মালিক আর দালালরাই নিল। গরু একটা পয়সাও নেয় নাই। আমি নিজে সাক্ষী! কিন্তু, অবুঝ মানুষদের এসব বুঝাবে কে? আর এত সময়ই বা কার ছিল?


 পরিশিষ্ট্য
গাবতলী থেকে আড়াই ঘন্টা বিরতিহীন হেটে গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার পর ঘরে ঢুকেই মা'কে জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার কি এখন ছোট খাট কোন কেক বানানো লাগবে?"
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কেন?"
নির্লীপ্ত জবাব দিলাম, "তাহলে সবকিছু মিক্স করে আমার মুখে রেখে দাও। ১০ মিনিটের মধ্যেই বেকড্ হয়ে যাবে।"
মা কিছু না বলেই ঠান্ডা পানি এঁগিয়ে দিলেন।
আসলে জীবনে প্রথমবারের মত গরু কেনার অভিজ্ঞতাটুকু খুব বেশি খারাপ যায় নি। তবে, সবচেয়ে ভাল অংশটুকু হলো সেই পানি খাওয়ার পর আমার টানা ৪ ঘন্টার ঘুম। আহা! শরীরটা এখন বড় চাঙা লাগছেরে!!